স্বদেশ ডেস্ক:
নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। আগের দিনের মতো গতকালও শতাধিক মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যুর ঢেউ-ই যে বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু কেন এই সংখ্যা এত বাড়ছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও অবহেলা, চিকিৎসাসেবা নিতে বিলম্ব, আইসিইউ ও ভেন্টিলেটলের সংকট, মারাত্মক ফুসফুস আক্রান্ত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
কয়েক দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরে করোনার ধরনের সঙ্গে এবারের মিল নেই। এবার আক্রান্ত হওয়ার দু-একদিনের মধ্যে ফুসফুস ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হচ্ছে; সময়মতো চিকিৎসা নিচ্ছেন না। ফলে মৃত্যু হচ্ছে।
করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকরা বলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর রোগীরা এটিকে সাধারণ ফ্লু বলে মনে করেন। কয়েক দিন দেখে করোনা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। ততদিনে তার শরীরে করোনা ভাইরাস শক্তিশালী হতে থাকে। করোনা শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসাসেবা না নিয়ে মনগড়া ওষুধ খেতে থাকেন। ভাইরাস তার ফুসফুস আক্রান্ত করেছে কিনা তা পরীক্ষার মাধ্যমে যাছাই করছেন না। এই অবহেলার কারণে দেখা যায়, তার ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। এ জটিল অবস্থায় যখন চিকিৎসা নিতে আসেন, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
এ ছাড়া জটিল রোগীদের জন্য অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধাও মৃত্যুর অন্যতম কারণ। জটিল রোগীদের জন্য সময়মতো আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর পাওয়া যায় না। শ্বাসতন্ত্রের রোগ কোভিড ১৯-এর জটিল রোগীদের জন্য কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের দরকার পড়ে। এবার নতুন করোনার ধরনে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেশি।
বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, রোগী সাধারণ বেডে বা কেবিনে আছে, কিন্তু জটিল অবস্থা। তার পরও আইসিইউতে সিট ফাঁকা না থাকায় রোগীকে সেই সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না। আইসিইউতে কোনো রোগী মারা গেলে অন্য একজনকে সেখানে নেওয়া হচ্ছে।
গত বছরের জুন-আগস্টে প্রথম ঢেউয়ে সংক্রমণ ছিল তীব্র। এবার ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে করোনা রোগী বাড়তে শুরু করে। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে এবার সংক্রমণের তীব্রতা, মৃত্যু ও আক্রান্তÑ সবই বেশি। ফলে হাসপাতালগুলো চিকিৎসাসেবা দিতে চরমভাবে হিমশিম খাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, মার্চের প্রথম সপ্তাহে (১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত) মারা গেছেন ৫৪ জন। এর মধ্যে ১ মার্চ ৮ জন, ২ মার্চ ৭ জন, ৩ মার্চ ৫ জন, ৪ মার্চ ৭ জন, ৫ মার্চ ৬ জন, ৬ মার্চ ১০ এবং ৭ মার্চ ১১ জন। বর্তমানে সেখানে ৯০ থেকে ১০০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১০১ জন, এর আগের দিন ১৬ এপ্রিল ১০১ জন, ১৫ এপ্রিল ৯৪ জন, ১৪ এপ্রিল ৯৬ জন, ১৩ এপ্রিল ৬৯ জন, ১২ এপ্রিল ৮৩ জন ও ১১ এপ্রিল ৭৮ জন। গত সপ্তাহে (১১ থেকে ১৭ এপ্রিল) মারা গেছেন ৬২২ জন। ১৭ দিন ধরে দেশে দৈনিক ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর পর ৬ এপ্রিল থেকে দৈনিক ৬০-এর ওপরে মৃত্যু হয়। গতকাল পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ২৮৩ জনের মৃত্যু হলো। সর্বশেষ এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৫ দিনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে করোনার নমুনা পরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত কমেছে। কিন্তু বেড়েছে মৃত্যু ও সুস্থতার সংখ্যা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নতুন রোগী শনাক্ত কমেছে ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর মৃত্যু বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সুস্থতাও বেড়েছে ৬১ দশমিক ২০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩৬টি জেলায় সঠিক চিকিৎসা সুবিধা নেই। ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় হাতেগোনা কয়েকটি আইসিইউ আছে। অনেক জেলায় ভেন্টিলেটরের কোনো সুবিধা নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগের ভাইরাসের ধরনে ১২ শতাংশ রোগীকে অক্সিজেন দিতে হতো। এখন ৮৬ শতাংশকে দিতে হচ্ছে। মুগদা হাসপাতালে দিতে হচ্ছে ৮১ শতাংশকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম টেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এর পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কারণে হচ্ছে মানুষের দেরিতে চিকিৎসা নেওয়া। অনেক মানুষ আছেন যাদের জ্বর বা অন্য কোনো কোভিডের মৃদু লক্ষণ দেখা দিলে তারা পরীক্ষা করান না। তাদের জ্বর বা অন্য কোনো উপসর্গ যেগুলো আছে, সেগুলো দু-তিন দিন পর ভালো হয়ে যাচ্ছে আর তারা মনে করেন ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু না, তিনি যদি কোভিড পজিটিভ রোগী হন, তা হলে জ্বর বা অন্য উপসর্গ চলে গেলেও ভাইরাসের কারণে ফুসফুসে ইনফেকশন বাড়তে থাকবে। একসময় দেখা গেছে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় ফুসফুসের ৫০-৬০ শতাংশ অকার্যকর। এই ধরনের রোগীদের জটিলতা বাড়ছে, ফলে কোভিড পজিটিভ রোগীর মৃত্যুও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, অনেকে কোভিড পজিটিভ হয়ে দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন। আবার অনেক রোগী হাসপাতালে গিয়েও শয্যা পাচ্ছেন না। চিকিৎসায় বিলম্ব হলে মৃত্যু বাড়বে। মানুষকে দ্রুত পরীক্ষা করতে হবে, চিকিৎসা নিতে হবে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এই মৃত্যু বেশি হওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে। যেমন রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। অনেকে জ্বর, সর্দিসহ কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃদু লক্ষণ হলে পরীক্ষা করছেন না। ফলে তারা একসময় কোভিড-১৯ সংক্রমণে জটিল হলে হাসপাতালে আসছেন। এতে তাদের একটি অংশ মারা যাচ্ছেন। আগে সরকারি হাসপাতালগুলোয় কোভিড রোগীর চিকিৎসা হতো, এখন বেসরকারি হাসপাতালে হচ্ছে। সেখানেও মারা যাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর পরিসংখ্যান একসঙ্গে হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। এই রোগে মৃত্যু কমাতে হলে এখন যেহেতু সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছে, তাই কারও কোভিডের কোনো লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া দরকার তিনি কোভিড পজিটিভ কিনা। যদি পজিটিভ হয়ে থাকেন, তা হলে চিকিৎসা নেবেন আর যদি পজিটিভ না হন, তা হলে সেইভাবে থাকবেন। কোভিড সংক্রমণের রোগী পরীক্ষা করে জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
নতুন আক্রান্ত ৩ হাজার ৪৭৩ : গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৬ হাজার ১৮৫টি। এর মধ্যে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ৪৭৩ জন। এ সময়ে নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৫১ লাখ ৫০ হাজার ৬৬৩টি নমুনা পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৭ লাখ ১৫ হাজার ২৫২ জন। মোট নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১০১ জন। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৬৯ জন পুরুষ এবং ৩২ জন নারী।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৫ হাজার ৯০৭ জন।
পরীক্ষা কমেছে : করোনার সপ্তাহিক সংক্রমণ পরিস্থিতির তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে (১১ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত) নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ১৭৪টি। এসব নমুনা থেকে রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৬ হাজার ৩১৫ জন। আর একই সময়ে মারা গেছেন ৬২২ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন। করোনার সাপ্তাহিক সংক্রমণ পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র বলছে- এক সপ্তাহের ব্যবধানে নমুনা পরীক্ষা ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ ও নতুন রোগী শনাক্ত ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে। আর একই সময়ে মৃত্যু ৩৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং সুস্থতা ৬১ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে।